
একটি প্রজন্মের জেগে ওঠা
রিদোয়ান কাদের :
২০২৫ সালের জুলাই। গ্রীষ্মের দগদগে দুপুর আর ধুলোবালির শহরে হঠাৎই যেন বাতাস থমকে যায়। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা তখন কোটার সংস্কারের দাবিতে জেগে উঠেছে। ঢাকায় আগুন, রাজশাহীতে গর্জন, আর চট্টগ্রাম ? চট্টগ্রাম তখন অপেক্ষা করছিল বিস্ফোরণের।
আমার চোখে দেখা চট্টগ্রামের আন্দোলন শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। ২ নম্বর গেইট, ষোলশহর, টাইগারপাস, নিউমার্কেট—এই সব নামগুলো তখন আর শুধু জায়গার নাম ছিল না, প্রতিরোধের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। আমরা তখন শহরমুখী। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কেউ কলেজ ছেড়ে, কেউবা গ্রামের ভিতর থেকে হেঁটে এসেছি শহরের এই রণাঙ্গনে।
১৬ জুলাই—একটি নাম, একটি তারিখ, একটি বিস্মৃত হতে না পারা দিন। শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর যখন পৌঁছায়, তখন রাস্তায় নেমে আসে এক সমুদ্র উত্তাল তরুণ। আমাদের কণ্ঠে তখন ছিল না কোনো রাজনৈতিক স্লোগান—ছিল শুধু প্রতিবাদের ধ্বনি, মুক্তির আর্তি।
কিন্তু সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ভয় পেল। ভয় পেয়ে পাঠাল সামরিক বাহিনী। শুরু হলো নির্বিচার গুলি। সেদিন, আমি চোখের সামনে দেখেছি ওয়াসিম ভাইকে রক্তাক্ত হতে, নিথর হয়ে পড়ে থাকতে। চারদিকে শুধু কান্না, আর্তনাদ, আর রক্তের গন্ধ।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, তখন সারা বাংলায় আগুন জ্বলছিল। সরকার কারফিউ জারি করল, বন্ধ করে দিল ইন্টারনেট। রাতের অন্ধকারে ছাত্রাবাসে হানা দিয়ে গুম করে নেওয়া শুরু করল ছাত্রনেতাদের। আমরাও লুকিয়ে থেকেছি, পালিয়ে থেকেছি, কখনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো বন্ধুদের ছাদে।
তবু থামিনি।
আমাদের হাতে ছিল না অস্ত্র, ছিল না বুলেট—ছিল বিশ্বাস আর লাঠি। সেই লাঠি নিয়েই আমরা দাঁড়িয়েছিলাম ট্যাঙ্কের সামনে, দাঁড়িয়েছিলাম রাইফেলের মুখোমুখি। আমরা জানতাম, এই আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের জন্য নয়—এই আন্দোলন একটি প্রজন্মের অস্তিত্বের দাবি।
এরপর আসে নতুন ধাপ—এক দফা দাবিতে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের লড়াইয়ে। ঢাকার দিকে রওনা হয় হাজারো শিক্ষার্থী—নাম দেয় ‘লং মার্চ টু ঢাকা’।
৫ আগস্ট, ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যায়। স্বৈরাচারের অবসান ঘটে। আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম নতুন একটি বাংলাদেশ।
এই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে রক্তে, সাহসে, আর বিশ্বাসে। আমার চোখে দেখা জুলাই আন্দোলন কেবল কিছু দিনের ঘটনা নয়। এটা ছিল এক জাতির আত্মজাগরণ, এক প্রজন্মের ঘোষিত যুদ্ধ। এই যুদ্ধের গল্পগুলো কেউ ইতিহাসে লিখবে, কেউ লিখবে কবিতায়। কিন্তু আমরা ? আমরা বয়ে নিয়ে চলবো আমাদের গায়ে লেগে থাকা সেই দিনের ধুলো, বারুদের গন্ধ, আর বুকে বাজতে থাকা সেই অবিনাশী প্রতিজ্ঞা—আর কোনো অন্যায়কে মেনে নেব না।
লেখক— যুগ্ম আহ্বায়ক (সাবেক), বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রাম উত্তর।
সদস্য, জুলাই রেভুলোশনারি এলায়েন্স
শিক্ষার্থী, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।