
মো. আবু সায়েম
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটলেও রাঙ্গুনিয়ায় গড়ে ওঠেনি কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকটে পিছিয়ে ছিল এ অঞ্চল। এমন সময় এক দূরদর্শী শিক্ষানুরাগী এগিয়ে আসেন — আবদুল ওহাব সিকদার।
১৯১২ সালে তিনি কাপ্তাই সড়ক সংলগ্ন সৈয়দবাড়ি এলাকায় ওয়াপদা অফিসের পাশে একটি সার্কেল মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল রাঙ্গুনিয়ার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অল্প সময়েই স্কুলটি ছাত্র—ছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চাইলেন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
পাঁচ মণীষীর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান
আবদুল ওহাব সিকদারের পাশে এসে দাঁড়ান চার জন শিক্ষানুরাগী ও সমাজহিতৈষী —
জ্ঞানদা রঞ্জন তালুকদার, উমেশ চন্দ্র মুৎসুদ্দী, রোহিনী রঞ্জন মুৎসুদ্দী ও প্রসন্ন কুমার দেব।
বিদ্যালয়ের জন্য ভূমি দান করেন দানবীর জ্ঞানদা রঞ্জন তালুকদার। জনসাধারণের সহায়তায় ১৯১৫ সালে শুরু হয় বিদ্যালয় ভবনের নির্মাণকাজ। প্রাথমিকভাবে একটি বাঁশের চালাঘরে শুরু হয় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন নলিনীকান্ত গুপ্ত।
ঘূর্ণিঝড়, সংগ্রাম ও নবযাত্রা
১৯১৯ সালে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যালয় ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তবুও বন্ধ হয়নি শিক্ষার চর্চা। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের অনুদানে নির্মিত টিনশেড ভবনে পুনরায় শুরু হয় পাঠদান।
ঐতিহাসিক অনুমোদন সংগ্রহ
বিদ্যালয়ের সরকারি অনুমোদন পেতে হয় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জি—র কাছ থেকে। সেদিন রাঙ্গুনিয়ায় একটি মহল বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে দেয়। এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে আবদুল ওহাব সিকদার স্যারের সামনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনার সুযোগ চান। মাত্র ২ মিনিট সময় চেয়ে শুরু করা বক্তৃতা চলে ২ ঘণ্টা। তাঁর বক্তৃতা, জ্ঞান, সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে স্যার আশুতোষ বলেন, “বাঙালির ঘরে ঘরে তোমার মতো আবদুল ওহাবের বড় প্রয়োজন।”
এভাবেই তিনি বিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে ফিরে আসেন। ১৯১৮ সালেই এই স্কুল থেকে ছাত্ররা প্রথম মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায়। ইতিহাসে জায়গা করে নেয় “রাঙ্গুনিয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়” নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠান।
পঞ্চমনীষীদের পরিচয়
আবদুল ওহাব সিকদার: বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক, শিক্ষক ও সহসভাপতি ছিলেন।
জ্ঞানদা রঞ্জন তালুকদার: ভূমিদাতা ও বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক ও সম্পাদক।
উমেশ চন্দ্র মুৎসুদ্দী: বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও খ্যাতিমান শিক্ষক।
রোহিনী রঞ্জন মুৎসুদ্দী: সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।
প্রসন্ন কুমার দেব: জনপ্রিয় শিক্ষক ও সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব, পরবর্তীতে ডাক্তার বিনয় ভূষণ দেবের পিতা।
এছাড়া, সাঁধু জীবন তালুকদার—ও বিদ্যালয়ের জন্য ভূমি দান করে ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
শেষ কথা
শিক্ষা বিস্তারের প্রাথমিক যুগে রাঙ্গুনিয়ার এই বিদ্যালয় ছিল এক আলোকবর্তিকা। সাহস, উদ্যম, ত্যাগ ও জনসম্পৃক্ততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আজও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে রাঙ্গুনিয়া আদর্শ বহুমুখী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।