আব্বাস হোসাইন আফতাব :
আল খায়েরের দুপুরটা ছিল অন্য দিনের মতোই রোদঝলমলে। সেদিনও সাইকেলের প্যাডেলে ভর দিয়ে ফিরছিলেন সঞ্জীব দাশ। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস,যেখানে কাজ পান, সাইকেল চালিয়ে যেতেন, আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে দিনের শেষে ফিরতেন নীড়ে। কিন্তু ১ ডিসেম্বরের সেই দুপুরে আর ঘরে ফেরা হলো না তার।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার নটুয়ারটিলা গ্রামের শান্ত স্বভাবের, পরোপকারী মানুষ সঞ্জীব দাশ (৪৩) বহু বছর ধরে ওমানের আল খায়ের এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের মতোই কঠোর পরিশ্রম করে চলছিলেন। ফ্রি ভিসায় থেকেও কার্পেন্টারি থেকে শুরু করে যেকোনো কাজ,তার কাছে কাজ মানেই জীবনের নিশ্চয়তা। আর সেই নিশ্চয়তার পথেই প্রতিদিনের মতো সেদিনও সাইকেলে ফিরছিলেন বাড়ির দিকে।
কিন্তু দ্রুতগামী একটি স্কুল বাস সবকিছু থামিয়ে দিল এক মুহূর্তে। ধাক্কা লেগে ছিটকে গিয়ে সঞ্জীব মাথায় আঘাত পান। পাশে দাঁড়ানো মানুষেরা ছুটে গেলেও লাভ হয়নি। জীবনের সবটা সংগ্রাম যেন শেষ হয়ে গেল সেই মুহূর্তেই। মরদেহ এখন স্থানীয় একটি হাসপাতালের মর্গে; দেশে ফেরার অপেক্ষায়।
সঞ্জীবের গ্রামে এখন শুধু শোক আর কান্নার শব্দ। বাবা, ভাই, স্ত্রী,কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে সঞ্জীব আর ফিরবেন না। তিন কন্যার হাসির উৎস বাবা আজ নিথর। মাত্র কয়েক মাস আগে তাদের সঙ্গে কাটানো সময়টুকুই এখন স্মৃতির সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ।
আরও হৃদয়ভাঙা এক সত্য,দুর্ঘটনার মাত্র এক মাস আগে গ্রামের প্রবাসী আব্দুল সবুরের মাধ্যমে পরিবারের পাঠানো রান্না করা খাবার খেয়েছিলেন সঞ্জীব। কে জানত, সেটাই হবে পরিবারের পাঠানো তার শেষ খাবার!
পরোপকারী, শান্ত, নীরব এক মানুষ ছিলেন সঞ্জীব। এলাকায় যে কারও বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়াতেন। নিজের জীবনটাও ছিল সংগ্রামের, কিন্তু ঠোঁটে হাসি ছিল চিরকাল। প্রবাসে যে মানুষটি প্রতিদিন নিজের ঘামের বিনিময়ে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতেন, তার চলে যাওয়া গ্রামটিকে নিঃশব্দ করে দিয়েছে।
সঞ্জীব দাশের মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়,এটি হাজারো বাংলাদেশি প্রবাসীর সেই নীরব সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, যারা নিজেরা কষ্ট সহ্য করে পরিবারের জন্য পৃথিবীর দূর দেশে থাকেন। তাদের জীবনের গল্পের ক্রমেই যেন শেষ নেই, কিন্তু প্রতিটি গল্পেই থাকে গভীর ক্ষয়ের দাগ।
সেদিন আল খায়েরের রোদ ঝলমল করলেও, সঞ্জীব দাশের পরিবার,পরিজনের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার দুপুর।